দেশি মুরগি আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী, যা স্থানীয় খামারিদের জন্য আয়ের অন্যতম উৎস। দেশি মুরগি পালনে খুব বেশি প্রযুক্তি বা আধুনিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন হয় না, তবে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করলে এর মাধ্যমে লাভবান হওয়া সম্ভব। দেশি মুরগি পালন শুধু আয়ের একটি মাধ্যম নয়, বরং এটি আমাদের কৃষি ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এখন চলুন জেনে নেওয়া যাক দেশি মুরগি পালনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি ও দিক।
১. প্রথমে খামার নির্বাচন
দেশি মুরগি পালনের জন্য খামার নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি আদর্শ খামার সাধারণত খোলামেলা, সূর্যালোক প্রাপ্ত এবং শুষ্ক স্থান হওয়া উচিত। মুরগির জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা রোগমুক্ত থাকে এবং সঠিকভাবে বৃদ্ধি পায়। খামারের পরিবেশ যেন সঠিক বাতাস চলাচল এবং পর্যাপ্ত আলো পায়, এটি নিশ্চিত করতে হবে।
২. মুরগির জাত নির্বাচন
দেশি মুরগির বিভিন্ন জাত রয়েছে, তবে সাধারণত "চিরুনি", "বাঙালি" এবং "কামরুল" জাতের মুরগি বেশি জনপ্রিয়। এসব মুরগি শক্তিশালী, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং তাদের ডিম দেয়ার ক্ষমতাও ভালো। তবে, শুরুতেই খামারের আকার এবং বাজেট অনুযায়ী যে কোন একটি জাত নির্বাচন করা উচিত।
৩. খাদ্য ও পুষ্টি
দেশি মুরগির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সঠিক পুষ্টির খাবার দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদের প্রধান খাদ্য হলো ভাতের খালি, ভূট্টা, গম, ভুসি, সবজি, ফলমূল এবং অন্যান্য গ্রামীণ খাবার তবে অবশ্যই চেষ্টা করবেন মুরগির সবুজ খাদ্য অব্যহত রাখতে।। প্রোটিন, মিনারেল এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার তাদের বৃদ্ধি এবং ডিম উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া, পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি দেওয়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪. মুরগির আশ্রয় বা বাসস্থানের ব্যবস্থা
দেশি মুরগির জন্য একটি সুরক্ষিত আশ্রয় বা বাসস্থান প্রয়োজন। এই বাসস্থানটি যেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, যাতে শিকারী বা পাখি তাদের আক্রমণ করতে না পারে। মুরগির জন্য একটি ছোট খাঁচা বা ঘর তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে তারা শীতের সময় গরম এবং গ্রীষ্মের সময় ঠাণ্ডা থাকতে পারে। আশ্রয়ে যথেষ্ট জায়গা থাকা উচিত যাতে মুরগি চলাচল করতে পারে।
৫. স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ
দেশি মুরগি পালনে স্বাস্থ্যবিধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা, টিকা দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা উচিত। মুরগি যাতে কোনো রোগে আক্রান্ত না হয়, সেজন্য তাদের আশ্রয়স্থল পরিষ্কার রাখা, খাবারের তাজাতা এবং সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। সাধারণ রোগের মধ্যে কোয়ালিডি, নিউক্যাসল, পোল্ট্রি ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রয়েছে, যা প্রতিরোধ করা সম্ভব, যদি নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও টিকা দেওয়া হয়।
৬. ডিম সংগ্রহ ও প্রজনন
দেশি মুরগি সাধারণত এক বছরে ৮০-১০০টি ডিম দেয়, তবে কিছু জাত বছরে ১৫০টিরও বেশি ডিম দিতে পারে। ডিম সংগ্রহের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন ডিমগুলো সঠিকভাবে সংগ্রহ করা হয়, যাতে তা ভাঙে না। প্রজনন ক্ষেত্রে, যদি আপনি নতুন মুরগি উৎপাদন করতে চান, তবে একটি পুরুষ এবং কয়েকটি মহিলা মুরগি রাখতে হবে। দেশি মুরগির প্রজনন প্রক্রিয়া খুব সহজ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিকভাবে হয়।
৭. বাজারজাতকরণ
দেশি মুরগি পালনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর বাজার চাহিদা। দেশি মুরগির মাংস ও ডিম সাধারণত ভালো দামেই বিক্রি হয়। মুরগির মাংস তুলনামূলকভাবে টেকসই এবং সুস্বাদু হওয়ায়, স্থানীয় বাজারে ভালো বিক্রি হতে পারে। এছাড়া, যদি বড় পরিসরে ব্যবসা করার পরিকল্পনা থাকে, তবে বড় মুরগির বাজার বা সরবরাহ চ্যানেলে যুক্ত হতে পারেন। দেশি মুরগির বাজার দর জানতে ভিডিওটি দেখতে পারেন।
৮. আয় ও লাভ
দেশি মুরগি পালন থেকে আয় তুলনামূলকভাবে ভালো হতে পারে। খামার সেটআপের খরচ কিছুটা বেশি হলেও, সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে এর আয়ের পরিমাণ বেশী হতে পারে। এক বছরে ১০০টির বেশি ডিম পাওয়া সম্ভব হলে, প্রতি ডিম বিক্রির দাম অনুযায়ী আপনার আয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে।
৯. দেশি মুরগির পালন থেকে পেশাগত লাভ
দেশি মুরগি পালন শুধু ব্যবসার মাধ্যম নয়, এটি অনেক কৃষকের জীবিকা নির্বাহের একটি উল্লেখযোগ্য উপায়। এটি খুবই লাভজনক হতে পারে, যদি আপনার খামার ভালোভাবে পরিচালিত হয় এবং সঠিক প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করেন। বিশেষত, দেশি মুরগির মাংস এবং ডিমের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায়, এর বাজার সম্ভাবনা আরও বেশি।
উপসংহার:
দেশি মুরগি পালন একটি লাভজনক ব্যবসা এবং এটি বিশেষ করে ছোট খামারিদের জন্য উপযুক্ত। সঠিক পরিচর্যা, খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, এবং পরিবেশের মাধ্যমে আপনি সহজেই একটি সফল মুরগি খামার তৈরি করতে পারেন। যদি আপনি দেশি মুরগি পালনে নতুন হন, তবে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে এবং নিয়মিত নজর রাখতে হবে আপনার খামারের ওপর। এটি শুধু আপনার পরিবারের জন্য নয়, দেশের কৃষি ব্যবস্থার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।